ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

ডিজিটাল আইন বাতিল নয়, সংস্কার দরকার 

সাব্বির আহমেদ 

প্রকাশিত : ১৭:০০, ৬ মার্চ ২০২১ | আপডেট: ২০:০৪, ৬ মার্চ ২০২১

সাব্বির আহমেদ 

সাব্বির আহমেদ 

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন (ডিএসএ) বাতিল নিয়ে দাবী তুলেছে অনেকে। এই আইনটি নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল। আপত্তিগুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেছে পত্রিকার সম্পাদকদের সংগঠন, সম্পাদক পরিষদ। জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ হওয়ার আগেই তাঁরা সরকারকে তাদের আপত্তিগুলো জানিয়েছিলেন। সরকার তাঁদের আপত্তির বেশ কিছু মেনে নিয়ে আইনটি সংশোধন করে এবং সংসদে তা পাশ হয়। সম্পাদক পরিষদের সব কয়টি আপত্তি গ্রহণ না করায় আইনটি নিয়ে তাদের অস্বস্তি থেকে যায়। 

সম্প্রতি ডিএসএ আইনের অধীনে মামলায় বিচারাধীন থাকাকালীন কুমির চাষি মোশতাক সাহেবের মৃত্যু আইনটিকে আবারও বিতর্কিত করে। বিশেষ করে ছয় বার জামিন চাওয়ার পরেও জামিন না পাওয়ায় বিষয়টি বাঙালির মানবিকতাকে ছুঁয়ে যায়। গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যম দুই ক্ষেত্রেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। একই আইনে কার্টুনিস্ট কিশোর কারাবন্ধী হওয়ায় এবং গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে নির্যাতন করা হয়েছে বলে তাঁর আইনজীবী সম্প্রতি আদালতকে জানালে আইনটি নিয়ে আপত্তি আবার তুঙ্গে ওঠে বা তুলে দেয়া হয়। আইনটি এখন আর সংশোধন নয়, পুরোপুরি বাতিলের দাবী করছেন অনেকে। যারা এই আইন বাতিলের দাবী তুলেছেন তাদের মধ্যে যেমন রয়েছেন রাজনৈতিক বিষয়ে গভীর ধারণা না রাখা সাধারণ রাজনীতি নিরপেক্ষ মানুষ তেমনি রয়েছেন রাজনীতিতে ঝানু জামায়াত, বিএনপি, বামাতি এবং তথাকথিত সুশীল সমাজ। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বাতিল হলে কার কতটা লাভ এবং ক্ষতি তা বিবেচনা না করে এই সাইবার ক্রাইম যুগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিল চাওয়া কি উচিৎ হচ্ছে? 

ইন্টার্নেটের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত ও গণযোগাযোগ সহজ হয়ে যাওয়ায় এবং সে যোগাযোগের সূত্রধরে ভাল ভাল বিষয়ের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের অনৈতিক, অসামাজিক, দুর্নীতি, জঙ্গি, মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ায় দেশে দেশে সাইবার সিকিউরিটি আইন প্রণয়ন করা শুরু হয় এই শতাব্দীর শুরু থেকেই। আমাদের দেশে প্রথম এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন হয় ২০০৬ সালে যা ইনফর্মেশন এণ্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি আইন (আইসিটি) নামে প্রচলিত ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। 

২০১৩ সালে একাত্তরের ঘাতক, দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে ব্যর্থ হয়ে জামায়াতে ইসলামী পুষ্ট বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী প্রথমে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের হত্যা করার মাধ্যমে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস শুরু করে। এই জঙ্গিরা তখন মুক্তমনা লেখক, ব্লগার এবং ফেসবুকে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে একে একে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সহজ উপায় হিসেবে তারা বিভিন্ন ধর্মের সাধক, যাজক, পুরোহিত ও নেতাদের এবং এখানে কর্মরত বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করতে থাকে। জঙ্গিরা হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা করে এক সঙ্গে ২০ জন মানুষ হত্যা দেশ বিদেশে আলোড়ন তৈরি করে। জঙ্গিরা সকল হামলাকেই আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠি আইএস এর হামলা বলে প্রচারণা চালায়। ফলে দেশে এক নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিদেশীরা তাদের কর্মকান্ড গুটিয়ে নিতে শুরু করে। একের পর এক বিদেশীদের হাতে নির্মানাধীন বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পের কাজ বন্ধ হতে থাকে। 

এমন সময়ে জামায়াত, বিএনপি, বামাতি ও সুশীল চক্র দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনা সরকার ব্যর্থ বলে অপপ্রচার চালিয়ে এখানে মার্কিন সেনা হস্তক্ষেপ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া বার্ণিকেট বাংলাদেশে আইএস জঙ্গি দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রাখার ব্যাপারে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশে মার্কিন আধিপত্যবাদ শুরু হয়। তখন থেকে জামায়াত, বিএনপি, সুশীল এবং বামাতী এরা সকলেই মার্কিন ধারার রাজনীতি করে আসছে। বিএনপি’র জন্মই হয় মার্কিন প্রেসক্রিপশনে। জামায়াতকে শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও জামায়াত ও তার সমমনা রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক এবং জঙ্গি সংগঠনগুলো আমেরিকানদের রাজনৈতিক, আর্থিক এবং অস্ত্র সহযোগিতা পেয়েছে। অন্যান্য দেশের জামায়াতের সমমনা সংগঠনগুলোর মধ্যে মিশরসহ বেশ কয়েকটি দেশে রয়েছে ইসলামী ব্রাদারহুড এবং তুর্কির একে পার্টি। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল একটাই – শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে দিয়ে জামায়াত-বিএনপি’র কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা। 

২০১৬ হলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় ২০ জন মানুষের হত্যাকাণ্ডের পর (যাদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি নাগরিক আর ৩ জন বাংলাদেশী) জঙ্গি দমনে সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করে। জঙ্গি দমন করতে গিয়ে সরকার সাইবার জগতে জঙ্গিদের অবাধ বিচরণ এবং এর মাধ্যমে কোমল মনের ধার্মিক তরুণদের ধর্মের নামে নিজেদের দলে টেনে বড় বড় হত্যাযজ্ঞ চালানোর সূত্র খুঁজে পায়। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ইন্টার্নেট তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জঙ্গিবাদের প্রচার এবং তরুণদের তথাকথিত জিহাদে নিয়োগ করার কাজ চালানো হয়। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকাসহ পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে এভাবে জঙ্গিরা তরুণদের জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত করে বিভিন্ন ধ্বংসাত্বক কাছে লিপ্ত করে। ইন্টার্নেটের মাধ্যমে জঙ্গিবাদসহ অন্যান্য অপরাধ দমনের জন্য ২০১৮ সালে আইসিটি আইনটি রদ করে ডিএসএ পাশ করা হয়। 

ডিএসএ বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা মূলত জঙ্গি দমন ও জামায়াতী প্রপাগান্ডা রোধ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ আইন অন্যান্য সামাজিক অপরাধ দমনেও কাজ করছে। জামায়াতী প্রপাগাণ্ডা কতটা ভয়াবহ হয় তার বেশ কিছু নজীর ইতোমধ্যে আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজব সামাজিক মাধ্যমে এবং পরে মসজিদের মাইক ব্যবহার করে প্রচার করে সে রাতে বহু আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মিসহ হত্যা করা হয়েছে অনেককে। ফেসবুকে মিথ্যা প্রচার করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বেশ কয়েকটি। আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছেঃ বেপরোয়া বাসের বিরুদ্ধে স্কুল, কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন যখন চলছিল তখন জামায়াতীরা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার চালিয়েছিল যে ধানমন্ডির আওয়ামী লীগ অফিসে অনেক ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, এখনো ধর্ষণ চলছে। জামায়াত, বিএনপি, সুশীল, বামাতি সকলে তখন ধানমন্ডি ছুটছিল আওয়ামী লীগ অফিস জ্বালিয়ে দিতে। পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ সেখানে উপস্থিত না থাকলে সেদিন আরেক ইতিহাস সৃষ্টি হত। 

যারা এই শতকের শুরুর দিক থেকে অনলাইনে জামায়াতী প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে; ১৩ সাল থেকে নতুন পর্বে যুদ্ধাপরাধীদের প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল যুদ্ধটা করেছে; জঙ্গি দমনে কাজ করেছে তারা ছাড়া অন্যদের পক্ষে ডিজিটাল আইনের প্রয়োজনীয়তাটা অনুধাবন করা সত্যি কষ্ট কর। কঠোর ডিজিটাইল আইন না থাকলে মৌলবাদী, জঙ্গি এবং না বুঝে তাদের সৃষ্ট গুজবে পালে বাতাস দেয়া নাদানদের হাত থেকে এই সাইবার যুগে বাঙালিকে নিরাপত্তা দেয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। 

আইনটা প্রয়োজনীয় সন্দেহ নেই। দেশে অপরাধ প্রবণ এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ মানুষেরও অভাব নেই। বিশেষ করে কমবেশি ক্ষমতা যাদের হাতে আছে তারা যে সহসাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন তা প্রায়ই আমরা সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাই। এই আইন দিয়ে যেমন জঙ্গি এবং গুজব সৃষ্টি করে ধ্বংসাত্বক কর্মকাণ্ড সৃষ্টিকারীদের আইনের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে তেমনি এই আইনের অপপ্রয়োগ করে কোন নির্দোষ নাগরিক যাতে কারো জিঘাংসা থেকে সৃষ্ট নির্যাতন ও দুর্ভোগের শিকার না হয় তার ব্যবস্থাও সরকারকেই করতে হবে। এর অপব্যবহার রোধে সরকারকে জোরালো মনিটরিং এর মাধ্যমে সোচ্চার থাকতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে লেখা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে লেখা এক কথা নয়। সরকারের কাজ কর্মের আলোচনা এবং সমালোচনা দুটোই লিখতে বা বলতে হবে। সরকারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু লিখলেই তাকে যেন এই আইনে ফাঁসানো না হয় তাও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। 

অন্যদিকে জামায়াতী ধ্বংসাত্বক প্রপাগাণ্ডার অতীত ইতিহাস বিবেচনা করে দেখা দরকার যে আইনটা না থাকলে ভবিষ্যতে কি কি ধরণের অপরাধ, সন্ত্রাস ও ধ্বংস হতে পারে। আইনটার কয়েকটি ধারা নিয়ে বিতর্ক আছে। সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা হচ্ছেঃ জামিন অযোগ্যতা। খুনের আসামীরও জামিন পাবার সুযোগ থাকা উচিৎ। মানুষের জীবনে এমন সব সময় আসে যে খুনের আসামীকেও জামিন দেয়া মানবতার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। জামিনের সুযোগ থাকলেই যে আসামীকে জামিন দিতে হবে – এমনও নয়। যথার্থ সংশোধন, সংস্কার এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে এই আইনের যথার্থ প্রয়োগই নিশ্চিত করে পারে নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার; নিরাপদ করতে পারে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রবাহ এবং সাইবার জগতের ভার্চুয়াল জীবন। 

 

লেখকঃ চার্টার্ড একাউন্টেন্ট (এফসিএ) এবং লিড কনসালট্যান্ট ও চেয়ারম্যান, ঢাকা কনসাল্টিং লিমিটেড।

আরকে//


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি